ছোটলোকের ভালবাসা


ব্যস্ত শহর ঢাকার সবচে' কর্মব্যস্ত এলাকা মতিঝিল। বিশেষত কমলাপুর স্টেশন থেকে আরমবাগ মোড় হয়ে শাপলা চত্বর - এরাস্তাটায় সারাক্ষণ ভীড় থাকেই। একে বাণিজ্যিক এলাকা তার উপর সারাদেশ থেকে আসা স্টেশনের মানুষের ভীড়, সাথে বেশ কয়েকটা স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী তো আছেই। রাস্তার সাথে সাথে দুপাশের ফুটপাতেও পথচারীর ভীড় বেশ। এ ব্যস্ত ফুটপাতেই ছোট্ট টং দোকান রাকিবের।

ছোটবেলায় এলাকায় বেশকিছুদিন মাদ্রাসায় পড়েছিল রাকিব। তারপর বেশকিছুদিন ভোকেশনালে। সেখান থেকেই এসএসসি পাশ করে সে। এরপর ঢাকায় আসে বাবার সাথে। বাবা সবজির ব্যবসা করে আর সে এই টং দোকানে চা বেচে।

একসারিতে পাচ-ছটা টং। অন্যদের চেয়ে রাকিবের দোকানেই ভীড় বেশি। বয়সে তরুণ হওয়ায় স্কুল-কলেজের ছাত্রদের সাথে অনেকটাই সহজ সম্পর্ক ওর। কলেজের ছেলেপুলে আড্ডা দেয় ওর টং এ চায়ের কাপ কিংবা সিগারেট হাতে। বিশেষত বিকালের দিকে আড্ডাটা জমে বেশ। চা-সিগারেট বিক্রিতে ব্যস্ত থাকলেও মাঝে মাঝেই আড্ডায় যোগ দেয় রাকিব, সে নিরব শ্রোতা। বাজারে আসা নতুন মোবাইল, ক্লাস বাংক, বাপের পকেট থেকে টাকা মারা এসবই আড্ডার বিষয়বস্তু। মাঝেমধ্যে স্কুল-কলেজ ফেরত মেয়েদের মেয়েদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করত: ইশারা-ইংগিত অথবা অর্থপূর্ণ হাসি যে কেও দেয়না তা নয়।

রাস্তায় প্রতিদিন কতজন এল গেল তা নিয়ে রাকিবের মাথাব্যথা নেই -কেবল ঐ একজন ছাড়া। ওর প্রতি অন্যরকম একটা টান অনুভব করে রাকিব। ব্যাংক কলোনিতে থাকে মেয়েটা। স্কুল যাওয়া আসা আর কোচিং মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে চারবার রাকিবের টং পেরুতে হয় ওকে। ওর স্কুল-কোচিং এর সময় রাকিবের মুখস্ত। প্রতিবার অদ্ভুত মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকে সে - ওর দিকে, অবশ্য দোকানে কেও না থাকলে। আখিও ব্যাপারটা খেয়াল করেছে- ছেলেটা কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে সবসময়। হুম- মেয়েটাই আখি।

মুখে কিছু না বললেও অন্যরা যখন আখির দিকে ইঙিত করে বাকা হাসি হাসে তখন রাকিবের বুকের বাম পাশে খচ করে কি যেন বিধে! একই সাথে কষ্ট আর রাগের মিশ্রিত একটা অনুভূতি তৈরী হয় তখন তার মনে। কিন্তু কিছু বলতে পারেনা কারণ ওরাই যে ওর কাস্টমার, টং টাই যে ওর ভাতের যোগান দেয়।

ভরদুপুর। রাকিব বেশ বিরক্ত ভঙ্গিতে বসে আছে দোকানে। কাস্টমার আজ প্রায় নাই বললেই চলে। হঠাত দোকানের পাশে আখিকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে যায় রাকিব। আখি ওকে জিজ্ঞেস করে ও এভাবে আখির দিকে তাকায় কেন। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে রাকিব। কোনমতে তোতলিয়ে জবাব দেয় 'আমি তোমারে... না মানে.. ইয়ে.. আপনারে ভাল পাই '। রাকিবের স্পর্ধা দেখে ক্ষেপে ওঠে আখি। কোথাকার কোন বস্তির ছেলে আসছে ভালবাসা দেখাইতে! হাহ, ছোটলোক কোথাকার। লজ্জায় অপমানে মাথা হেট হয়ে আসে রাকিবের। সে তো খারাপ কিছু করেনি। যে কাউকে ভাল লাগতেই পারে। সে ফুটপাতে টং দোকান করে বলে কি তার ভাললাগা থাকতে পারে না? আখি গটগটিয়ে হেটে চলে যায়। এরপর রাকিব কোনদিন আখি তো দুরে থাক কোন মেয়ের দিকেই চোখ তুলে তাকায়নি।

বেশ কিছুদিন পর। রাকিবের দোকানে নতুন একটা ছেলেকে আড্ডা দিতে দেখা যায়। অপু - নতুন এসেছে, এজিবি কলোনিতে থাকে। প্রতিদিন বিকালে অনেকটা সময় সে টং এ আড্ডা দেয়। দামি সিগারেট ফুকে বাপের টাকার শ্রাদ্ধ করে। অপু ছেলেটা কেমন যেন -প্লেবয় টাইপের। কয়েকদিন পরপর রিলেশন গড়ে আর ভাঙে। আর সেই কাহিনী শুনিয়ে আড্ডা মাতিয়ে তোলে।

ইদানীং অপুর চোখ পড়েছে আখির উপর। ব্যাংক কলোনিতে থাকে মেয়েটা। বাবা বাংলাদেশ ব্যাংকের লিফট-ম্যান না কি যেন। এসব খবর সে কিভাবে যেন পেয়ে যায়। বাপে কি করে না করে তাতে অপুর কিছু যায় আসেনা। মেয়েটা সুন্দরি আছে। এসব মেয়েদের পটানোও সহজ। যে করেই হোক এমেয়েকে তার চাই!
বেশ স্মার্ট অপু। মাঞ্জা মেরে বেড়ায় সবসময়। থ্রি কোয়ার্টার আর টিশার্ট, চুল স্পাইক করা। একটা রেসিং সাইকেলও আছে। এরকম একটা ছেলের প্রেমে পড়তে আখিদের আর ক'দিনই বা লাগে! ফাদে ধরা দেয় পাখি। রাকিব চুপচাপ দেখে যায় সব চুপচাপ। সেতো বস্তির ছেলে-ছোটলোক। বড়লোকদের দিকে তাকানোর কিংবা তাদের ব্যাপারে মাথা ঘামানো তার কাজ নয়।

সামনে ভ্যালেন্টাইন ডে। এজিবি কলোনির পোলাপান কলোনিতে নাকি ডিজে পার্টি দিবে। পোস্টার ও ছাপা হয়ে গেছে। রাকিবের সাথে ওদের সম্পর্ক ভালই। সে সূত্রে ডিজের পোস্টার লাগানো , টিকেট বিক্রি এসব রাকিবই করে। ডিজের নানা প্লান পরিকল্পনা ওর দোকানেই হয়।

ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ। বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয় আখি। সেখান থেকে অপুর সাথে ডিজে পার্টিতে যায়। পার্টিতে আখিকে দেখে অবাক হয় রাকিব। এতটা ও কল্পনা করতে পারেনি।
কিছুক্ষণ নাচানাচির পর আখির হাত ধরে অপু বেড়িয়ে যায়। রাকিবের মনে খটকা লাগে। পিছু নেয় সে। অপু এগিয়ে যায় কলোনির কোণার দিকে। পরিত্যক্ত দুটো বিল্ডিং ওই সাইডে। সন্ধ্যা নামছে। চারদিকে আবছা অন্ধকার। এসময় এদিকটায় কেও আসেনা খুব একটা। অপুর অভিসন্ধি বুঝতে পারে রাকিব। পার্টিতে হালকা ড্রিংক্সের ব্যবস্থা ছিল।
কিন্তু কি করবে ভেবে পায়না সে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে কিছুক্ষণ। অপ তততক্ষ্ণেু আখিকে নিয়ে একটা ভাঙা বিল্ডিং এ ঢুকে পড়েছে। কি করা উচিৎ ভেবে বের করার আগেই হঠাত ভোতা একটা শব্দ কানে আছে তার - অনেকটা গোঙানির মত। দৌড়ে গিয়ে দেখে আখি অপুর সাথে ধস্তাধস্তি করছে। আখির ওড়না একপাশে পড়ে আছে। আখির মুখ চেপে ধরেছে অপু। আর সহ্য হয়না রাকিবের। কান্ডজ্ঞান হারিয়ে পাশে পড়ে থাকা স্টিলের ভাঙা রড উঠিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে অপুর মাথায় বাড়ি মারে। মাথায় হাত চেপে ঢলে পড়ে অপু, আর্তনাদ বেড়িয়ে আসে মুখদিয়ে। ফেটে গিয়েছে জায়গাটা। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেড়ুচ্ছে। রক্ত দেখে হুশ হয় রাকিবের। আখি ওড়না উঠিয়ে তা দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে। তার চোখেমুখে আতঙ্ক। হ্যাচকা টানে আখির হাত ধরে বেড়িয়ে আসে রাকিব। আখিকে বাসার সামনে দিয়ে সোজা চলে যায় বাবার কাচামালের দোকানে। সেখান থেকে বস্তিতে। ব্যাগ-পোটলা গুছিয়ে বস্তি ছাড়ে তাড়াতাড়ি। সেদিনই ঢাকা ছাড়ে রাকিব। কমলাপুর স্টেশনে প্লাটফর্মের ১ম ট্রেনটায় চড়ে পাড়ি দেয় গ্রামের উদ্দেশ্যে।
বেচে থাকার জন্য - দুটো টাকা রোজগারের জন্য শহরে এসেছিল রাকিব, অনেক স্বপ্ন নিয়ে। ধুলোয় ধুসরিত হয় সে স্বপ্ন - বিনিময়ে মুক্তি পায় ভালবাসা। ছোটলোকের ভালবাসা।

Comments