হেডফোন

সবাই বলে মানুষ চেনা যায় জুতায়। আসলে মানুষ চেনা যায় হেডফোনে। এই যেমন প্যাঁচ খাওয়া হেডফোন সবসময় কানে গোঁজা থাকলে বুঝতে হবে ছেলেটা বা মেয়েটা আসলে বিষণ্ণতায় ভুগছে। আবার নিঃসঙ্গতায় ভোগা মানুষদের হেডফোন হয় এখানে-ওখানে টেপ লাগানো, অনেকটা ঝিমিয়ে যাওয়া মতন। এরা সবকিছুর মায়া ছাড়তে পারে কিন্তু হেডফোনের মায়া এরা কোনভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারেনা ; পুরোনো হেডফোনটাই টেপ-টুপ লাগিয়ে চালিয়ে নেয়। সাথে জোড় করে আঁকড়ে ধরা পুরোনো কিছু স্মৃতি। নতুন চকচকে হেডফোনওয়ালারা হয় বিলাসী। এরা হেডফোনে গান শোনে কিছুটা অবসর কাটানোর জন্য, বাকিটা শখের বশে।

সে কথা থাক। হেডফোনের অভাববোধ প্রবলভাবে মাথা চারা দিয়েছে দুদিন হল। শেষ হেডফোনটা পরশু বাস থেকে নামতে গিয়ে টান লেগে ছিঁড়ে গিয়েছে। আগে থেকেই ওটার অবস্থা অবশ্য বেশ খারাপ ছিল - শরীরভরা কালো-সাদা টেপের ব্যান্ডেজ। হেডফোনটা কিনে দিয়েছিল অদ্রি - নীলক্ষেত থেকে।

গত ফাল্গুনে দুজনে হাটছিলাম শহীদ মিনারের সামনে দিয়ে। আমার এক কানে হেডফোনে চলছে ডিফারেন্ট টাচের 'শ্রাবণের মেঘগুলো '। অদ্রি কি যেন বলছিল। অন্যমনস্ক ছিলাম বলে শুনতে পাইনি। হঠাৎ আমার সামনে দাড়িয়ে একটানে হেডফোনটা খুলে ফেলল। আমি অবাক হওয়ার আগেই দেখি ওটার রক্তারক্তি অবস্থা, মাইক্রোফোনের জয়েন্টটার কাছে ছিঁড়ে গিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম - কি হল?
কি হয়নি সেটা বল? এই রোদে শাড়ি পরে তোমার সাথে হাটতে বেরিয়েছি কি তোমার হেডফোনে বাজা গানের ক্যানভাস হতে?
এতক্ষণে খেয়াল করলাম মেয়েটা আজ শাড়ি পরেছে। শাড়ির কুচিতে আনাড়ি হাতের ছাপ থাকলেও তাতেই মেয়েটাকে অসাধারণ লাগছে। আমি অদ্রির চোখের দিকে তাকালাম। টলটলে দুই চোখে কিছুটা মায়া, কিছুটা অভিমান সাথে কিছুটা রাগও। বেশিক্ষণ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারিনা - ঘোর লেগে যায়। চোখ নামিয়ে নিলাম। একপাশে তাকালাম খাপছাড়া দৃষ্টিতে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি অদ্রি এখনও এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হেডফোনটায় চোখ পড়ল - কেমন যেন মায়া লাগছিল একটা অসহায় ভাবও ফুটে উঠল মুখে। অদ্রিরও চোখ পড়ল ছেঁড়া হেডফোনটার উপর। ও জানে হেডফোনটা আমার খুব প্রিয়। ওর অভিমানবোধের জায়গায় হঠাৎ করেই অনুশোচনাবোধ জাগ্রত হল বোধহয়।
পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল বের করে হেডফোনটা খুলে নিল। আমাকে বলল - রিক্সা ডাক, নীলক্ষেত যাব চল।
রিক্সা থেকে নেমে এক দোকানে হেডফোন দেখা শুরু করল। আমি পাশে দাড়িয়ে দেখছিলাম। কয়েকটা হেডফোন কানে লাগিয়ে টেস্ট করল। শেষে সাদা একটা হেডফোন মনে ধরল বোধহয়। হেডফোনটা প্যাকেটে নিয়ে আমাকে দিল। একটু পর কি ভেবে যেন প্যাকেট থেকে হেডফোনটা বের করে আমার হাতে দিল। ব্যাগ থেকে ছেঁড়া হেডফোনটা বের করে প্যাকেটে ঢুকিয়ে প্যাকেটটা ব্যাগে রেখে দিল। হাতের ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে আমাকে টেনে বলল - চল।
মাস দুয়েক পর একটা স্কলারশিপ পেয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যায় ও। যাবার কয়েকদিন আগেও একদিন ডাচে বসে জিজ্ঞেস করেছিল - সারাজীবন কি এভাবে উদাস মনে গান শুনেই কাটিয়ে দেবে? গলায় উদাসী ভাব আরও খানিকটা বাড়িয়ে উত্তর দিয়েছিলাম - হয়তো!

অদ্রি চলে যাওয়ার পরও আমার উদাস ভাব কাটেনি। একদিন আজিজের নিচে চা খাচ্ছি। কানে সেই হেডফোন। হঠাৎ করেই অনির সাথে দেখা - অদ্রির ছোটবোন। কি যেন একটা বই কিনতে এসেছে। চা খেতে খেতেই জানলাম অদ্রি আমার হেডফোনের সেই প্যাকেটটাও নাকি মহাযত্নে ওয়্যারড্রোবে রেখে দিয়েছে। ততদিনে অবশ্য প্যাঁচ লেগে - দুএক জায়গায় ছিঁড়ে লাল-কালো টেপের আচ্ছাদনে সাদা হেডফোনটা তার রঙ হারিয়ে ফেলেছে।

এইতো পরশুদিন পর্যন্ত সেই হেডফোনটা আমার চব্বিশঘণ্টার সঙ্গী ছিল। আর্টসেলের 'পথচলা' থেকে গ্রীন ডেইস এর 'বুলভার্ড অফ ব্রোকেন ড্রিমস' পর্যন্ত কত অলস দুপুরে, ব্যস্ত রাস্তার নিরেট জ্যামে, হাঁটা পথে, টিএসসির বিকেলে কিংবা মধ্যরাতের অবশেসনে সবসময়ি নিঃস্বার্থ বন্ধুর মত সঙ্গ দিয়েছে হেডফোনটা! আজ কেন যেন অদ্রির কথা মনে পড়ছে খুব, খুউব!

[কদিন ধরেই তীব্র হেডফোন সংকটে ভুগছি। সেই সংকটের জের ধরেই কিছুটা সময় কাটানোর প্রয়াসে লিখে ফেললাম। না হয়েছে গল্প - না অনুগল্প - না কি! আসলে কিছুই হয়নি :D ]

Comments