রিভিউঃ কত না অশ্রুজল - সৈয়দ মুজতবা আলী

মানুষের অনন্য বৈশিষ্ট্য যোগাযোগে ভাষার ব্যবহার। সমসাময়িক অন্যান্যদের সাথে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তার আবেগ-অনুভূতি-অভিজ্ঞতার কথা জানাতে সে অক্ষরে লেখে তার মনের কথা। তবে মানুষ চিঠি লিখে দূরান্তে থাকা তার একান্ত প্রিয়জন, আপনজনের কাছে; নিতান্তই তার মনের কথা। আর নিশ্চিত মৃত্যু জেনে আপনজনের কাছে লেখা শেষ চিঠিতে মানুষ লিখে তার সব না বলা কথা, রোমন্থন করে তার প্রিয়তম স্মৃতি, পরোক্ষে বিদায় নেয় জীবনের তরে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত হয় কয়েক কোটি মানুষ। এই যুদ্ধে আহত-নিহত সৈনিক-সাধারণের এবং কনসান্ট্রেশন ক্যাম্পে ভয়ঙ্কর-নিশ্চিত মৃত্যুর আগে প্রিয়জনের কাছে লিখিত সেই সময়ের অনেকগুলো চিঠি নিয়েই সৈয়দ মুজতবা আলীর কত না অশ্রুজল। জীবনের প্রতি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা-আকুতির নিপাট নিদর্শন এই চিঠিগুলোর বেশিরভাগই Die Stimme des Menschen. Briefe und Aufzeichnungen aus der ganzen Welt নামক চিঠি সংকলন থেকে অনুবাদকৃত।
হিলডে নাম্নী এক যুবতীর কনসান্ট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুর আগে তার মায়ের কাছে লেখা চিঠি আছে এতে। স্বামীসহ গ্রেফতার হয় সে। ক্যাম্পে স্বামীর মৃত্যু হয়ে গ্যাছে ততদিনে। এই ক্যাম্পেই জন্ম নেওয়া তাদের সন্তানকে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয় হিলডে। মৃত্যুর আগে মায়ের কাছে লেখা চিঠিতে সন্তান আর মায়ের প্রতি যুগপৎ ভালোবাসার প্রকাশ বড়ই করণ!
স্ত্রী য়াকোকে লেখা জাপানী সেনা কিকিয়ের শেষ চিঠিতে আছে স্ত্রী-সন্তানের প্রতি আকুন্ঠ ভালোবাসা আর প্রিয়জনের নৈকট্যের দুর্নিবার আকর্ষণের প্রকাশ। ফ্রান্সের এক যুবকের চিঠি আছে এতে, যেখানে ফাঁসির মঞ্চে আরোহণের পূর্বে পিতার কাছে লেখা শেষ চিঠিতে সে নিজের ঠিকানা হিসেবে লিখেছিল ‘প্রযত্নে ভগবান’! কিংবা ইতালীতে গৃহযুদ্ধ চলাকালীন এক জোয়ানের বিরোধী শিবিরের গুলিবিদ্ধ আরেক জোয়ানকে মৃত্যুশয্যায় ‘মা’ ডাকতে শুনে তার নিজের মায়ের কাছে লেখা হৃদয়বিদারক চিঠিও আছে এতে।
লেখকের প্রবাস জীবনের বন্ধু পউলের ভাই কার্ল, যুদ্ধের সময় যাকে কমুনিস্ট সন্দেহে নাৎসি বাহিনী ধরে নিয়ে যায়; কারাগারে আত্মহত্যার আগে পউলকে লেখা কার্লের তিন শব্দের চিঠির কথাও লেখক এতে লিখেছেন। কারাগারে দগ্ধ হতে হতে আত্মহননের ঠিক আগে সিগারেটের প্যাকে দেশলাইয়ের কাঠি পুড়িয়ে ভাইকে লেখা সেই চিঠির গল্প বড়ই করুণ। কার্ল-পউলের পরিবারের সাথে লেখকের অন্তরঙ্গ পরিচয় ছিল। এক ইস্টারে লেখককে দূর দেশে উপহার-তক পাঠিয়েছিল যে কার্ল, তার লেখা শেষ চিঠির গল্প বলতে গিয়ে লেখকের গভীর বেদনাবোধ তিনি কোনভাবেই আড়াল করতে পারেননি।
মৃত্যু নিশ্চিত জেনে, যুদ্ধাবস্থায় মৃত্যুর মুখোমুখি বসে মানুষ আর যাই করুক – স্বভাবত মিথ্যা বলেনা, ছলনা করেনা; বরং গভীর জীবনবোধ থেকে উৎসরিত কথাগুলোই সে বলে যায়। মৃত্যুর আগে লেখা শেষ লেখাগুলো থেকে জীবনের প্রতি মানুষের আকুতি-আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বরুপ অনুধাবন করা যায়। করুন রসে পূর্ণ হলেও করোনার দিনগুলোতে ‘কত না অশ্রুজল’ পড়ে দেখতে পারেন। জীবনের প্রতি দুর্নিবার টান নতুনভাবে আরেকবার উপলব্ধ হলেও হতে পারে।

Comments