নিখিলেশ স্যার স্মরণে

রাত জাগাটা অভ্যাসে পরিণত হয় কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে। এর আগেও রাত জাগতাম না তা নয়। একাবারে নিয়ম করে রাত জাগার শুরু তখন আরকি। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে সকালের শিফটের ক্লাস শেষে ঘুমোতে যেতাম। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে আপ্যায়নে নাস্তাটা করে উস্কোখুস্কো চুলে ইষৎ লাল চোখে ক্লাসে যাওয়া ততদিনে অভ্যাসে দাড়িয়েছে। এক গুরু জহরলাল স্যারের ক্লাস ছাড়া অন্যান্য ক্লাসে স্যারেরা ওপেন ফ্লোরে কোন প্রশ্ন ছুড়ে দিলে স্বেচ্ছায় সেসবের উত্তর দেওয়ার পথ মাড়ানো তো দূরে থাক, স্যার আমার দিকে ইঙ্গিত করে দাঁড়াতে বললেও আসেপাশে বা সামনে-পিছনে তাকিয়ে স্যার যে আমাকে ডেকেছেন সেটা না বোঝার ভান করতাম। ক্লাস তো আর আরামবাগের আড্ডা না যে ধাপ্পা মেরে চালিয়ে দেওয়া যায়। সবসময় যে বেঁচে যেতাম তা নয়। মাঝেমাঝেই গুরুর অলঙ্ঘনীয় আদেশে কিছু সময় দাঁড়িয়ে বাক্যবাণ হজম করতে করতে মুফতে প্রাপ্ত নীতিকথাগুলো ঝুলিতে ভরতাম।
তো এমনই একদিন, নিখিলেশ স্যারের বাংলা ক্লাস। স্যারের ক্লাস ভালোই লাগত। সেদিন কার মুখ স্বপ্নে দেখে ঘুম ভেঙেছিল জানিনা; ক্লাস শুরুর কিছুক্ষণ পরেই স্যার সোজা আমার দিকে তাকিয়ে ডাকলেন 'দাঁড়াও মিয়া'। এই রে- গেছে একেবারে। কোনভাবেই ফাঁকি দেওয়া গেলনা। রো-নাম্বার ধরে একেবারে ডেকে নিয়ে গেলেন ডায়াসে। মাথা থেকে পা অব্দি তাকিয়ে নিরীহ ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলেন - 'চিড়িয়াখানায় গ্যাছ কখনও?'
তখনও বুঝি নি কি আসছে। অ্যাকাডেমিক কোন একটা প্রশ্ন করে ছেড়ে দিক। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলাম।
- জ্বি স্যার
- বান্দর দেখছ; বান্দর?
অতঃপর...
১৪ ব্যাচের গ্রুপ থ্রি এর মানুষজন এই অধমকে চিনতে পারুক বা না পারুক সেইদিন স্যার যা দিয়েছিলেন - সেই গল্প এতদিনেও ভুলেছে বলে মনে হয়না।
তো এর মাস খানেক পরের কথা, আমি তখন মোহাম্মদপুর থাকি। কি এক কাজে শিয়া মসজিদের দিকে গিয়েছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ স্যারের সাথে দেখা। ডায়াসের সেইদিনের সিন মনে করে আদাবটা দিয়ে কোনমতে পাশ কাটিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। স্যার দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন কই যাও।
অনেকক্ষণ আলাপ করলেন। নানান বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। বাইরে পড়তে এসেছি, কি থেকে সাবধান থাকতে হবে না-হবে ইত্যাদি বিষয়ে বললেন। কলেজের স্যারদের সাথে ছাত্রদের ইন্টারেকশন নিয়ে নানান গল্প শুনেছি, কিন্তু এতখানি কষ্মিনকালেও আশা করিনি।
তাও আবার নিখিলেশ স্যারের কাছে। হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজ পার হয়ে নবোদয় হাউজিং-এ স্যারের বাসাতক গিয়েছিলাম সেদিন। বন্ধুদের চোখে হয়ত ধরাই পড়েনি স্যারের ক্লাসে আমার মনযোগ হুট করে বেড়ে গিয়েছিল। সেদিন হাঁটতে হাঁটতে হাউজিং সোসাইটির ৫ নাম্বার রোডের মাথায় যে রেস্টুরেন্টটা আছে সেটায় খাওয়ানো শর্মার গুণে নয়। স্যারের ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা থেকেই ক্লাসে মনযোগী হয়েছিলাম।

কিছুক্ষণ আগে এক ছোটভাই জানাল স্যার আর নেই। নিউমোনিয়া নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শে চাঁদপুর থেকে ঢাকা আসার পথে স্যার গত হয়েছেনে। জীবনে অনেক শিক্ষকের সান্যিধ্যে এসেছি, আরো আসব। কিন্তু স্যারের মতো কারোর সাথে হয়তো আর দেখা হবেনা।
যেখানেই থাকবেন ভালো থাকবেন স্যার!

-সিফাত
৮ মে ২০২০

Comments